ধারাবাহিক: ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্র
পর্ব ২: মঞ্চযাত্রা – অঙ্গ রচনার কাহিনি
প্রবন্ধ
PARTHA PRATIM ACHARYA
4/14/20251 min read


(অধ্যায় ২ অবলম্বনে)
"যেখানে শ্রোতা দেখে ও শোনে, সেখানে নাট্য জীবন্ত হয়ে ওঠে। আর সেই স্থানটি হতে হবে পবিত্র, সুনির্মিত এবং রসমণ্ডিত।"
— ভরত মুনি
এক পবিত্র নির্মাণ: রঙ্গমঞ্চের জন্ম
কল্পনা করুন—এক বিশাল খোলা প্রান্তর। চারদিকে ঋষিদের জটাজুট, দেবগণের চঞ্চল মুখাবয়ব। এক তরুণ ঋষি, ভরত, ব্রহ্মার নির্দেশে প্রস্তুত হচ্ছেন এক অব্যর্থ আয়োজনের। মঞ্চ গঠনের সেই মহান আয়োজন, যেখানে দেবতারা দর্শক হবেন, আর মর্ত্যলোক শিখবে কেমন হয় নাট্যরসের স্বাদ।
মঞ্চ গঠন নাট্যশাস্ত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ের মূল বিষয়বস্তু। ভরত মুনির ভাষায়, নাট্য অভিনয়ের যে পটভূমি, সেটি হতে হবে এমন—যেখানে দেবতারা সন্তুষ্ট, মানুষ মোহিত, এবং শিল্প পূর্ণতা পায়।
তিন রকম মঞ্চ: গঠনের গাণিতিক দৃষ্টিভঙ্গি
ভরত মুনি মঞ্চকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন:
বৃহৎ (মহারঙ্গ) – ১০৮ হাত দীর্ঘ, রাজসভা বা বৃহৎ আসরে ব্যবহৃত
মধ্যম (মধ্যমরঙ্গ) – ৬৪ হাত, সর্বাধিক উপযোগী ও ব্যালান্সড
হ্রস্ব (ক্ষুদ্ররঙ্গ) – ৩২ হাত, ছোটো আসরের জন্য উপযুক্ত
এখানে "হাত" একটি প্রাচীন দৈর্ঘ্য একক—প্রায় আধুনিক ‘ফুট’-এর কাছাকাছি। নাট্যশাস্ত্রে বলা হয়েছে, মধ্যমরঙ্গ-ই শ্রেষ্ঠ, কারণ এটি দর্শক ও অভিনয়ের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে।
পবিত্রতা ও স্থাপত্য: একটি মঞ্চের আত্মা
মঞ্চ নির্মাণের আগে ভূমিকে বিশুদ্ধ করতে হয়। ভূমি শোধন, বীজ সঞ্চার, ও পূর্বরঙ্গের আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করতে হয়। এটি একপ্রকার ‘স্থাপত্যযজ্ঞ’—যেখানে ভূমির পবিত্রতা ছাড়া নাট্য শুরু হয় না।
দৃষ্টিকোণ: আজকের আধুনিক থিয়েটার হলে আমরা আলো, শব্দ, অ্যাকুস্টিকসের কথা ভাবি। অথচ প্রাচীন ভারতে, একটি নাট্যমঞ্চ নির্মাণ শুরুর আগেই ভূমিতে যজ্ঞ, মন্ত্রোচ্চারণ, এবং দিকনির্ণয় হতো। এর মাধ্যমে শুধু স্থাপত্য নয়, আত্মিক ভারসাম্যও বজায় রাখা হতো।
রঙ্গপীঠ ও নট্যগৃহ: স্থানের আভ্যন্তরীণ নির্মাণ
রঙ্গপীঠ: যেখানে নাট্য উপস্থাপন হয়—অর্থাৎ মূল মঞ্চ।
নট্যগৃহ: নাট্যমন্দিরের বৃহত্তর কাঠামো, যেখানে দর্শক আসন, প্রবেশপথ, সংগীতের আসন, সাজঘর ইত্যাদি থাকে।
ভরত মুনি মঞ্চের মধ্যে ‘নাট্যধর্মী স্থাপত্য’-এর ধারণা দেন—যা স্থাপত্যের মধ্যে নাট্যভাব প্রকাশ করে। প্রতিটি দিক, প্রবেশপথ, উচ্চতা, এমনকি আসনের বিন্যাসও নির্দিষ্ট শাস্ত্রীয় নিয়মে নির্ধারিত।
শ্রুতি ও দৃষ্টি: দর্শকের অবস্থান একটি বিজ্ঞান
একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা—মঞ্চ নির্মাণ এমন হতে হবে যাতে প্রত্যেক দর্শক স্পষ্টভাবে দেখতে ও শুনতে পারেন। একে বলা হয়েছে শ্রুতি ও দৃষ্টির সমতা।
আজকের থিয়েটার ডিজাইনের মূলেও এই ধারণা রয়েছে—একটি শ্রুতিকেন্দ্র (acoustic focal point) এবং দৃশ্যত সাম্যতা (visual symmetry)। ভরত মুনি সেই প্রাচীন যুগেই এগুলো বিশ্লেষণ করেছেন।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে অনুরণন
আজকের সময়ে আমরা থিয়েটার ডিজাইন করি ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি আর লাইট ডিজাইনারদের সহযোগিতায়। কিন্তু নাট্যশাস্ত্রের যুগে একজন ঋষিই ছিলেন স্থপতি, দার্শনিক, নাট্যকার ও সুরকার একযোগে।
এই অধ্যায়টি আমাদের শেখায়—নাট্য শুধু অভিনয়ের নয়, এটি স্থান, রীতি, সমাজ ও দর্শকের সাথে এক আত্মিক সংলাপ।
উপসংহার
নাট্যশাস্ত্রের দ্বিতীয় অধ্যায় আমাদের এক পবিত্র নির্মাণকলার শিক্ষা দেয়। এটি শুধুমাত্র ‘মঞ্চ’ গঠনের কথা বলে না, এটি শিল্প ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণে নাট্যমঞ্চকে ‘তীর্থ’ বানানোর কথা বলে।
