নাট্যশাস্ত্র পর্ব ৪
ভাব ও অভিনয় – রসের পূর্বসূত্র.
প্রবন্ধ
পার্থ প্রতিম আচার্য
6/23/20251 min read
নাট্যশাস্ত্র পর্ব ৪: ভাব ও অভিনয় – রসের পূর্বসূত্র
১. ভাব কাকে বলে?
ভাব মানে অনুভব। নাট্যশাস্ত্রে “ভাব” সেই মানসিক অবস্থা যা চরিত্রের ভিতরে কাজ করে এবং দর্শকের মনে ছড়িয়ে পড়ে।
ভাব নেই মানে নাটকে প্রাণ নেই।
ভারত মুনি বলেন,
“রস নিঃসরণ হয় ভাব থেকে। যেমন ফুল থেকে গন্ধ।”
২. ভাবের চারটি রূপ
১. স্থিতিভাব – মূল আবেগ
স্থায়ী, গভীর, চরিত্রের ভিত্তি।
যেমন: প্রেম, করুণা, রোষ, ভয়, বীরত্ব, হর্ষ, বিরক্তি
গল্প:
নাটকে একজন বিধবা মা আছে। তাঁর মনে স্থিতিভাব হলো “করুণা”—ছেলের মৃত্যুর জন্য নয়, সমাজের নিষ্ঠুরতার জন্য।
২. ব্যভিচারীভাব – চলমান, পার্শ্ব অনুভব
২৬ রকমের এই ভাবগুলো মূল ভাবকে ঘিরে ওঠে–নামে যেমন "ব্যভিচারী", অর্থাৎ 'চঞ্চল'।
কিছু ব্যভিচারীভাব:
সন্দেহ
ঘৃণা
লজ্জা
আনন্দ
ক্লান্তি
বিষণ্ণতা
স্বপ্ন
স্মৃতি
ক্রোধ
গল্প:
একজন যোদ্ধা মঞ্চে আসে। মুখে হাসি, কিন্তু চোখে ক্লান্তি। সে বলছে, “জিতেছি, কিন্তু আমার বন্ধু হারিয়ে গেছে।”
এখানে স্থিতিভাব: বীরতা,
ব্যভিচারীভাব: ক্লান্তি, স্মৃতি, বিষাদ
৩. সাত্ত্বিক ভাব – শরীর ও মন একসাথে কাঁপে
এই ভাব শুধু অভিনয় নয়, সত্যিকারের অনুভব—মনে যা বাজে, দেহে তা প্রকাশ পায়।
উদাহরণ:
চোখে জল
কাঁপুনি
হাঁপ ধরা
ঘাম
বাক্য আটকে যাওয়া
রঙ বদলে যাওয়া
গল্প:
এক বৃদ্ধা মঞ্চে বসে থাকেন। কেবল একটা চিঠি পড়েন, চোখে জল আসে, ঠোঁট কাঁপে। কিছু বলেন না।
এটিই সাত্ত্বিক অভিনয়, যা দর্শককে গভীরে ছুঁয়ে দেয়।
৪. বিভাব – যে উপাদান ভাবকে জাগায়
বিভাব মানে "উদ্দীপক"—যে ব্যক্তি বা বস্তু বা পরিবেশ চরিত্রের ভিতরের ভাব জাগায়।
🔹 দুই ভাগে বিভক্ত:
আলম্বন বিভাব: প্রেমিক, প্রেমিকা, রাজার আদেশ ইত্যাদি
উদীপন বিভাব: ফুলের গন্ধ, রাতের নিস্তব্ধতা, বজ্রপাত ইত্যাদি
গল্প:
নাটকে এক বৃদ্ধ তার মৃত স্ত্রীর কাপড় হাতে নেয়। তার মুখে কোনো সংলাপ নেই।
স্ত্রীর স্মৃতি = আলম্বন বিভাব
কাপড়ের গন্ধ, একাকীত্ব = উদীপন বিভাব
এই সব মিলে তৈরি হয় করুণ রস।
আঙ্গিক অভিনয়ের সংজ্ঞা
আঙ্গিক অভিনয় বলতে বোঝানো হয় সেই অভিনয়, যা অভিনেতার দেহ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মুখ, চোখ, হাত, পা ইত্যাদি ব্যবহার করে ভাব ও রস প্রকাশ করে।
ভারত মুনি এটিকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন:
শরীর
এইটি হলো সমগ্র দেহ। অর্থাৎ, মঞ্চে অভিনেতার দাঁড়ানোর ভঙ্গি, দেহের সামগ্রিক গঠন, ভারসাম্য এবং উপস্থিতি—এই সবকিছু মিলিয়ে যে দেহভাষা তৈরি হয়, তাকেই বলে ‘শরীর’। একজন চরিত্রের ব্যক্তিত্ব বোঝাতে, তার আত্মবিশ্বাস, দ্বিধা কিংবা ক্লান্তি প্রকাশ করতে ‘শরীর’-এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন, একজন রাজা চরিত্র মঞ্চে এসে বুক টান করে, মাথা উঁচু করে দাঁড়ালে দর্শক সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে—এই ব্যক্তি ক্ষমতাবান।
অঙ্গ
শরীরের বড় অঙ্গগুলি—যেমন হাত, পা, চোখ, কপাল, মাথা, ভ্রু ইত্যাদির গতিবিধি বোঝাতে ‘অঙ্গ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এগুলি হচ্ছে নাটকীয় ভঙ্গির মূল বাহক। অভিনেতা যখন হাত তুললেন, অথবা চোখ বড় করে তাকালেন, বা মাথা এক পাশে ঝুঁকলেন—তখন তার ভেতরের ভাব বা ইচ্ছা প্রকাশ পায়।
যেমন, রাগ প্রকাশ করতে চোখে জ্বালা, কপাল কুঁচকানো, হাত মুঠো করা—এই অঙ্গভঙ্গি স্বাভাবিকভাবেই রাগের রস তৈরি করে।
উপাঙ্গ
এইটি হলো শরীরের সূক্ষ্ম এবং ছোট ছোট অংশ, যেমন—নাসিকা (নাক), অধর (ঠোঁট), দন্ত (দাঁত), চিবুক, গাল, চাহনি (দৃষ্টিভঙ্গি), ইত্যাদির ব্যবহার। অভিনয়ে সূক্ষ্ম অনুভূতি বা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা বোঝাতে ‘উপাঙ্গ’ অপরিহার্য।
যেমন, প্রেমের দৃশ্যে অভিনেত্রীর চোখের লাজুক তাকানো, ঠোঁটের হালকা কম্পন বা চিবুকের নিচু হয়ে যাওয়া—এই সব কিছুই উপাঙ্গ-অভিনয়ের অন্তর্গত।
চোখের চাহনি – "নয়ন যখন নট"
নাট্যশাস্ত্রে চোখের ৩৬ রকমের ভঙ্গি বলা হয়েছে!
তবে কিছু সাধারণ ভঙ্গি:
সমচোখ: সামনে তাকানো – স্থিরতা বোঝায়
চলিত: দৃষ্টি এদিক ওদিক – কৌতূহল
ভীত: চক্ষু বড় বড় – ভয়
ত্রস্ত: চঞ্চল, বারবার দৃষ্টি বদল – উন্মাদনা বা দুশ্চিন্তা
লজ্জিত: নিচের দিকে তাকানো – নম্রতা বা প্রেম
উদাহরণ:
একজন নারী তার প্রাক্তনের দিকে চেয়ে হাসছে না, কিছু বলছে না। কিন্তু চোখে স্পষ্ট প্রেম আর অভিমান। দর্শক বুঝে যায়, সংলাপের প্রয়োজন নেই।
হাতের ভঙ্গিমা – "হস্তয বঞ্চনা নাস্তি"
ভারত মুনি বলেন,
"হস্তই নাট্যের প্রাণ।"
তিনি ২৪ রকমের হস্তমুদ্রার বিবরণ দিয়েছেন, যার মাধ্যমে:
জয় প্রকাশ করা যায় (ত্রিপদ হস্ত)
প্রেম বোঝানো যায় (অলিঙ্গ)
ক্রোধ বোঝানো যায় (মুষ্টি)
প্রার্থনা বোঝানো যায় (অঞ্জলি)
ভারতীয় নাট্য ও নৃত্যকলায় এই হস্তমুদ্রাগুলির ভুমিকা অপরিসীম। এগুলির সাহায্যে এককভাবে একটি পূর্ণ কাহিনী বলা যায়—যেমনটা ভারতনাট্যম, কুচিপুড়ি বা কাথাকলি-তে দেখা যায়।
উদাহরণ:
রাজা ক্রোধে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তোলে—একটিই অঙ্গভঙ্গি বলল, “আমি শাস্তি দেব।”
হাঁটার গতি – "গমনেই গম্ভীরতা"
অভিনেতার হাঁটার ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায় তার চরিত্র:
ধীর গতি – সাধু, গুরুজন
চঞ্চল গতি – প্রেমিক/কিশোর
ভঙ্গিমাযুক্ত গতি – রমণী
তেজী গতি – বীর চরিত্র
উদাহরণ:
একজন চরিত্র মঞ্চে ঢুকছে ধীরে ধীরে, মাথা নিচু করে—সেই মুহূর্তে দর্শক বুঝে যায়, সে হয়ত পরাজিত বা গম্ভীর কিছু ভাবছে।
বসার ভঙ্গি – "আসনে অভিব্যক্তি"
কীভাবে কেউ বসে আছে তা থেকেই বোঝা যায় তার মানসিক অবস্থা:
সোজা হয়ে বসা = আত্মবিশ্বাস
কুঁকড়ে বসা = লজ্জা/ভয়
এলিয়ে বসা = অবসাদ
টান টান বসা = উত্তেজনা বা বিচারপর্বে প্রস্তুত
উদাহরণ:
বিচারসভায় একজন অভিযুক্ত কাঁপা গলায় বসে, হাত কোলের মাঝে, পা কেঁপে যাচ্ছে—এটাই বলছে তার অস্থিরতা ও ভয়।
আঙ্গিক অভিনয় যেন এক নীরব কবিতা, যেখানে প্রতিটি ভঙ্গি একটি শব্দ, একটি অনুভব।
ভারত মুনি কেবল শরীরের ভাষাকে নাটকে অন্তর্ভুক্ত করেননি—তিনি এটিকে শিল্পের মর্যাদা দিয়েছেন।
আজও শ্রুতি-নাটক হোক বা নিঃশব্দ অভিনয়—আঙ্গিক অভিনয় নাটকের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাচিক অভিনয়: কণ্ঠ যখন কাব্য হয়
কী এই বাচিক অভিনয়?
বাচিক অভিনয় মানে সংলাপ বলার ধরণ।
একটি সংলাপ কেমন করে বলা হচ্ছে—তার স্বর, ছন্দ, গতি, ঠেক, বিরতি, চিৎকার, কিংবা নীরবতা—এই সব কিছু নিয়েই বাচিক অভিনয়।
ভারত মুনি বলেন,
"একই কথা একাধিকভাবে বলা যায়, তাতে বদলে যায় অর্থ ও অনুভব।"
উদাহরণ:
সংলাপ: "তুমি আসবে তো?"
আশায় ভরা কণ্ঠে: প্রেমে অপেক্ষা
কাঁপা গলায়: দুশ্চিন্তা
রাগে ধমকে: অভিমান
চুপচাপ, দীর্ঘ নিঃশ্বাসের পরে: হাল ছেড়ে দেওয়া
সংলাপ: "আমার ছেলে কোথায়?"
মা যখন খুঁজছে হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে: গলা কাঁপবে, নিঃশ্বাস ছেঁড়াবে
পুলিশ অফিসার যখন জেরা করছে: কণ্ঠ দৃঢ়
বৃদ্ধ বাবা চুপচাপ জিজ্ঞেস করছে: কণ্ঠে ক্লান্তি, ব্যথা
একেক রকম বাচিক, একেক রকম নাটকীয়তা।
২. সাত্ত্বিক অভিনয়: অনুভব যখন শরীরে কথা বলে
সাত্ত্বিক কাকে বলে?
সাত্ত্বিক অভিনয় হলো সেই অভিনয়, যা হৃদয়ের গভীর অনুভব থেকে শরীরের প্রতিক্রিয়ায় প্রকাশ পায়।
এটা জোর করে করা যায় না, এটা আসে অভিনেতার অন্তর্দৃষ্টি থেকে।
সাত্ত্বিক অভিনয়ের চিহ্নসমূহ:
১. চোখে জল
২. কাঁপুনি
৩. ঘাম
৪. গলার স্বর আটকে যাওয়া
৫. পেশি শক্ত হয়ে যাওয়া
৬. নিঃশ্বাস ভারী হওয়া
৭. শরীরের রঙ পরিবর্তন
উদাহরণ:
একজন মা মঞ্চে বসে শুধু একটি জুতা ধরে কাঁদছে। তার মুখে শব্দ নেই, চোখে জল, শরীর কাঁপছে।
সাত্ত্বিক অভিনয়।প্রেমিক শুনলো তার প্রিয় মানুষের মৃত্যু সংবাদ। সে এক পা এগিয়ে থেমে যায়, মুখ শক্ত হয়ে যায়, মুখে কিছু নেই—কিন্তু দর্শক বুঝে যায় সে অভিভূত।
এই অনুভব, যা শরীর ও আত্মা একসাথে প্রকাশ করে, এটাই সাত্ত্বিক।
৩. আহার্য অভিনয়: দৃশ্যত ভাষা
আহার্য কী?
আহার্য অভিনয় মানে মঞ্চসজ্জা, পোশাক, আলোক পরিকল্পনা, মুখাভিনয়, এবং সাজসজ্জা।
যা দর্শকের চোখে পড়ে, এবং নাটকের চরিত্র, পরিবেশ ও রসকে গাঢ় করে তোলে।
ভারত মুনি এটিকে বলেন,
"যা দেখে দর্শক চরিত্রকে বিশ্বাস করে, তা আহার্য।"
আহার্যের উপাদান:
১. পোশাক ও অলঙ্কার – চরিত্রের শ্রেণি, পেশা, মানসিক অবস্থা বোঝায়
২. মেকআপ ও মুখাভিনয় – বয়স, জাতি, দুঃখ বা আনন্দের অভিব্যক্তি
৩. মঞ্চসজ্জা ও রং – সময়কাল, পরিবেশ, আবহ
৪. আলো ও শব্দ পরিকল্পনা – নাটকীয়তা বৃদ্ধি করে
উদাহরণ:
এক সন্ন্যাসী চরিত্রে সাদা পোশাক, কাঠের মালা, সাদামাটা আলো = শান্তির অনুভব
যুদ্ধের দৃশ্যে অন্ধকার মঞ্চ, লাল আলো, ঢাকের শব্দ = উত্তেজনা
রমণীর সাজ-পোশাকে যদি লাল, সোনা, গয়না থাকে, দর্শক বোঝে সে রাজপ্রাসাদের কেউ
এই চার পদ্ধতি একসাথে মিলে গড়ে তোলে এক পূর্ণাঙ্গ নাট্য অভিজ্ঞতা।
ভাব + অভিনয় = রস
ভাব একা কিছুই নয়। সেটা প্রকাশে আসে যখন অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চে চরিত্র রস সৃষ্টি করে।
দর্শক তখন নাটক দেখে না, মনে অনুভব করে।
উপসংহার
ভাব হচ্ছে নাটকের আত্মা। আর অভিনয় হচ্ছে তার শরীর।
ভাব যদি আগুন হয়, অভিনয় তার আলো ও উত্তাপ।
ভারত মুনির ভাষায়,
"যেখানে ভাব, সেখানেই রস। আর রসই নাট্যের পরম উদ্দেশ্য
