ভারতীয় নাট্যবিদ্যা: ভারতীয় নাট্যবিদ্যা: নাট্যশাস্ত্রের দর্শন ধারাবাহিক

প্রথম অধ্যায়

প্রবন্ধ

পার্থ প্রতিম আচার্য

3/28/20251 min read

নাট্যশাস্ত্রের ভূমিকা ও উদ্দেশ্য------------নাট্যশাস্ত্র-এর প্রথম অধ্যায় -

ভরত মুনির রচিত নাট্যশাস্ত্র হল ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে নাটক ও অভিনয় কলার উপর সবচেয়ে বিস্তৃত ও প্রভাবশালী গ্রন্থ। ধারণা করা হয়, এই গ্রন্থটি খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিস্টীয় ২০০ সালের মধ্যে রচিত হয়েছিল, যদিও এর উপদেশ ও মৌখিক ঐতিহ্য আরও প্রাচীন। নাট্যশাস্ত্র শুধু নাটকীয় কলার একটি নির্দেশিকা নয়; এটি একটি গভীর দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক দলিল যা নাটক, সংগীত, নৃত্য এবং অভিনয়ের মূলনীতি ব্যাখ্যা করে। প্রথম অধ্যায়, যা নাট্য উৎপত্তি অধ্যায় নামে পরিচিত, সেখানে নাট্যকলার ঐশ্বরিক উৎপত্তি, সমাজে এর উদ্দেশ্য এবং সাধারণ মানুষের শিক্ষা ও বিনোদনের জন্য এটি কীভাবে তৈরি হয়েছে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ভরত মুনি নাট্যকলার একটি নতুন রূপের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন, যা একদিকে যেমন বিনোদন (ক্রীড়া), অন্যদিকে তেমনই নৈতিক শিক্ষা (ধর্ম) প্রদান করবে। নাট্যশাস্ত্র রচিত হওয়ার সময় সমাজ বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত ছিল এবং আধ্যাত্মিক ও বৌদ্ধিক জ্ঞানের প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের জন্য সীমিত ছিল। ভরত মুনি ব্যাখ্যা করেন যে নাট্যকলা একটি নতুন জ্ঞান, যা সর্বজনীন এবং সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের জন্য সহজলভ্য। প্রথম অধ্যায়ে ব্রহ্মা ঘোষণা করেন যে নাট্যকলা হল "পঞ্চম বেদ" (পঞ্চম বেদ), যা অপর চারটি বেদের সারাংশ নিয়ে তৈরি এবং এটি সেইসব মানুষের জন্যও উন্মুক্ত, যাদের জন্য বৈদিক অধ্যয়ন নিষিদ্ধ। এই ঘোষণার মাধ্যমে নাট্যকলাকে একটি পবিত্র ও রূপান্তরকারী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, যা ধর্মীয় এবং পার্থিব উভয় ক্ষেত্রে কার্যকর।

এই গ্রন্থ অনুযায়ী নাট্যকলার উদ্দেশ্য বহুমুখী। এটি নৈতিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং সামাজিক মন্তব্যের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এটি মানুষের জীবনের আনন্দ, দুঃখ, ক্রোধ, প্রেম এবং সহানুভূতির অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে। মঞ্চে এই আবেগ ও পরিস্থিতিগুলির উপস্থাপনা দর্শকদের সহমর্মিতা গড়ে তুলতে এবং মানব আচরণের জটিলতা বোঝাতে সহায়তা করে। ভরত মুনি আরও বলেন, নাট্যশাস্ত্র রাজা, সাধারণ মানুষ এবং ঋষিদের জন্য সমানভাবে উপযোগী, যা শিক্ষা ও বিনোদন উভয় দিকেই কার্যকর। ভরত মুনির মতে, নাট্যকলার মূল লক্ষ্য হল মানব আত্মাকে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করা এবং জীবনের গভীর সত্য উপলব্ধি করানো।

নাট্যকলার পৌরাণিক উৎপত্তি

নাট্যশাস্ত্র-এ নাট্যকলার উৎপত্তি সম্পর্কে একটি আকর্ষণীয় পৌরাণিক বিবরণ দেওয়া হয়েছে, যা এর ঐশ্বরিক ও পবিত্র অবস্থান প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম অধ্যায় অনুযায়ী, দেবতারা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে একটি নতুন শিল্পকলার জন্য অনুরোধ জানান, যা দেবতা ও মানব উভয়ের জন্য বিনোদন ও শিক্ষা প্রদান করবে। দেবতাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ব্রহ্মা চারটি বেদের মূল উপাদান থেকে নাট্যবেদ তৈরি করেন:

  • ঋগ্বেদপাঠ্য (সংলাপ), যা নাটকে সংলাপ ও আবৃত্তি গঠনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

  • যজুর্বেদঅভিনয় (অঙ্গভঙ্গি), যা দেহভাষা ও অভিব্যক্তিকে নির্দেশ করে।

  • সামবেদগান (সঙ্গীত), যা কণ্ঠ ও বাদ্যযন্ত্রের সুরের অন্তর্ভুক্ত।

  • অথর্ববেদরস (ভাব ও আবেগ), যা নান্দনিক অনুভূতি ও আবেগের প্রকাশ করে।

এই চারটি মূল উপাদান একত্র করে ব্রহ্মা এমন একটি শিল্প তৈরি করেন, যা মানুষের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে উপস্থাপন করতে সক্ষম। এই নতুন বেদটি সর্বজনীন ছিল, যা বর্ণ ও শ্রেণির সীমা অতিক্রম করে সকলের জন্য জ্ঞান ও আনন্দ প্রদান করে।

নাট্যবেদ সৃষ্টি করার পর, ব্রহ্মা এটি ঋষি ভরতকে প্রদান করেন। ভরত মুনি তাঁর একশত পুত্রসহ এই ঐশ্বরিক শিল্পের প্রথম অনুশীলনকারী ও শিক্ষক হয়ে ওঠেন। ব্রহ্মার নির্দেশে ভরত ও তাঁর শিষ্যরা প্রথম নাটক মঞ্চস্থ করেন, যা দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধের কাহিনি তুলে ধরে এবং এটি ইন্দ্রধ্বজ উৎসবে প্রদর্শিত হয়।

এই প্রথম নাট্যপ্রদর্শন ভাল ও মন্দের চিরন্তন সংগ্রামকে উপস্থাপন করে এবং নাট্যকলার মৌলিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে। তবে, অসুররা নিজেদের উপহাসিত ও অপমানিত মনে করে এই নাটকের বিরোধিতা করে। তাদের আপত্তির জবাবে ব্রহ্মা আশ্বাস দেন যে নাট্যকলা হবে একটি সামগ্রিক শিল্প, যা মানব অভিজ্ঞতার সব দিক তুলে ধরবে, যেখানে গুণাবলী ও ত্রুটির উভয় দিকই সমানভাবে উপস্থাপিত হবে। এই ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ নাট্যকলার অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রকৃতি তুলে ধরে, যা শুধু বিজয় নয়, বরং জীবনের সংগ্রাম ও অসম্পূর্ণতাকেও প্রতিফলিত করে।

পঞ্চম বেদের দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

নাট্যকলাকে পঞ্চম বেদ হিসাবে ঘোষণা করার অর্থ হল এর আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া। যেখানে চারটি বেদ ধর্মীয়, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে তুলে ধরে, সেখানে নাট্যশাস্ত্র সেই শিক্ষাকে নাট্য ও নান্দনিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। এটি পবিত্র জ্ঞান ও জনপ্রিয় সংস্কৃতির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, যাতে গভীর সত্যগুলি শৈল্পিক উপস্থাপনার মাধ্যমে সহজবোধ্য হয়।

ভরত মুনির নাট্যকলার দর্শন মূলত রস তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে, যা দর্শক নাটক থেকে যে আবেগময় ও নান্দনিক অনুভূতি লাভ করে তা ব্যাখ্যা করে। পরবর্তী অধ্যায়ে রস তত্ত্বে আটটি প্রধান অনুভূতির (শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বিভৎস, এবং আদ্ভুত) কথা বলা হয়েছে, যা নাট্যকলার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই তত্ত্ব নাট্যকলার পরিবর্তনশীল শক্তিকে গুরুত্ব দেয়, যা দর্শকদের মধ্যে জটিল আবেগ সৃষ্টি করতে ও তাদের মনকে বিশুদ্ধ করতে সহায়ক।

এছাড়া, নাট্যশাস্ত্র নাট্য প্রযোজনার জন্য একটি সুসংগঠিত কাঠামো প্রদান করে। এতে মঞ্চ পরিকল্পনা, চরিত্রের ধরন, কাহিনি নির্মাণ, পোশাক, মেকআপ এবং সংগীত সম্পর্কে বিশদ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভরত মুনির সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়, যেখানে প্রতিটি উপাদান মননশীল উপস্থাপনার মাধ্যমে একটি সুষম ও অর্থবহ অভিজ্ঞতা প্রদান করে।

উপসংহার

নাট্যশাস্ত্র-এর প্রথম অধ্যায় নাট্যকলার ঐশ্বরিক উৎপত্তি ও সর্বজনীন উদ্দেশ্য বর্ণনা করে। ভরত মুনি নাট্যকলাকে পঞ্চম বেদ হিসেবে ঘোষণা করে একে একটি পবিত্র শিল্পে উন্নীত করেছেন, যা সামাজিক সীমানা অতিক্রম করে শিক্ষা ও আত্মিক উন্নয়নের মাধ্যম।

ব্রহ্মার দ্বারা নাট্যবেদ সৃষ্টির পৌরাণিক বিবরণ নাট্যকলার সার্বিক প্রকৃতি তুলে ধরে, যেখানে ভাষা, অঙ্গভঙ্গি, সংগীত এবং আবেগ একত্রিত হয়েছে। ভরত মুনির এই গ্রন্থ নাট্যকলার জন্য একটি প্রযুক্তিগত নির্দেশিকা প্রদানের পাশাপাশি শিল্পের মাধ্যমে মানব অভিজ্ঞতার গভীর সত্য উপলব্ধির একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে।

You can mail me